পারিবারিক ও সামাজিক ভারসাম্য বজায় রাখতে অভিভাবকের ভূমিকা অপরিসীম।
ইসলামী আইনে এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। আরবি ‘হিজানাত’-কে বাংলায় বলা
হয় ‘অভিভাবক’। হিজানাত বা অভিভাবক শব্দের অর্থ লালন-পালন, তত্ত্বাবধান ও
দায়িত্ব গ্রহণ। অভিভাবক বলতে সে ব্যক্তিকে বোঝায়, যে ব্যক্তির কাছে কোনো
নাবালক বা নাবালিকার শরীর বা সম্পত্তি বা উভয়ের তত্ত্বাবধান রয়েছে এবং
প্রতিপাল্য বলতে তাকে বোঝায়, যার শরীর বা সম্পত্তি বা উভয়ের জন্য অভিভাবক
বা অভিভাবিকা রয়েছে। মুসলিম আইনের ৩৪৮-৩৬৮ ধারায় এবং ১৮৯০ সালের
অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইনে অভিভাবক ও প্রতিপাল্য বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে।
সাধারণত অভিভাবকত্ব নাবালক বা নাবালিকার শরীর, সম্পত্তি ও বিয়ের ক্ষেত্রে
বিবেচিত হয়। মুসলিম আইনে ১৫ বছরে পদার্পণ করেনি এমন কাউকে নাবালক বা
নাবালিকা বোঝায়।
এবার দেখা যাক, মুসলিম আইনে কে নাবালক বা নাবালিকার শরীর, সম্পত্তি ও
বিয়ের অভিভাবক বা অভিভাবকা হিসেবে উপযুক্ত। প্রথমত নাবালক বা নাবালিকার
শরীর মুসলিম আইনে পুত্রসন্তানের বয়স সাত বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এবং
কন্যাসন্তানের বয়োসন্ধি বা পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্তা না হওয়া পর্যন্ত মা তার
হেফাজতে রাখার অধিকারিণী হলেও তিনি স্বাভাবিক ও আইনানুগ অভিভাবিকা নন।
পিতা বা দাদা বা তাদের নিযুক্তীয় নির্বাহকই বৈধ ও আইনানুগ অভিভাবক (ধারা-
৩৫২)। মায়ের মৃত্যুর পর বা কোনো যৌক্তিক কারণে মা এ অধিকার হারালে নাবালক
বা নাবালিকার নানি, দাদি, আপন বোনসহ অন্যান্য নিকটতম আত্মীয় নারীর ওপর
অভিভাবকত্বের দায়িত্ব বর্তায় (ধারা-৩৫৩)। অন্যদিকে মা-সহ অন্যান্য নিকটতম
আত্মীয়ের নারীরা বিভিন্ন কারণে হেফাজতের বা অভিভাবিকার দায়িত্ব হারান।
যেমন- নাবালক বা নাবালিকার সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত নয়, এমন কোনো নিষিদ্ধ ধাপের
কাউকে বিয়ে করলে, নাবালক বা নাবালিকার মা তাদের বাবার বাসস্থান হতে অন্যত্র
চলে গেলে, অনৈতিক জীবনে জড়িয়ে পড়লে, নাবালক বা নাবালিকাকে সঠিক পরিচর্যা
না করলে, অন্য ধর্ম গ্রহণ করলে, পিতাকে নাবালক বা নাবালিকার কাছে যেতে বাধা
দিলে (ধারা-৩৫৪)। অন্যদিকে পুত্রসন্তানের বয়স সাত বছর এবং কন্যাসন্তানের
বয়ঃপ্রাপ্তির পর পিতার হেফাজতের অধিকার সৃষ্টি হয়। পিতার অবর্তমানে দাদা
এবং তাদের অবর্তমানে অন্যান্য নিকটতম আত্মীয়ের পুরুষদের ওপর এ অধিকার
বর্তায়। এক্ষেত্রে শর্ত থাকে যে, কোনো পুরুষই অবিবাহিত বালিকার হেফাজতের
অধিকারী হবেন না, যদি না সে ওই বালিকার সহিত মুসলিম আইনের ২৬০-২৬১ ধারা
অনুযায়ী নিষিদ্ধ ধাপের আত্মীয় সম্পর্কের হয় (ধারা-৩৫৫)। উল্লেখ্য, মা বা
অন্যান্য নিকটতম আত্মীয়ের মহিলারা যে কারণে হেফাজতের বা অভিভাবিকার
দায়িত্ব হারান, প্রায় একই কারণে পিতা ও অন্যান্য নিকটতম আত্মীয়ের পুরুষরাও
হেফাজতের বা অভিভাবকের দায়িত্ব হারান। পিতা বা নিকটতম পুরুষ আত্মীয়দের
অবর্তমানে অভিভাবক বা অভিভাবিকা নিয়োগের দায়িত্ব আদালতের ওপর বর্তায়
(ধারা-৩৫৭)। এ ছাড়া নাবালিকা স্ত্রীর অভিভাবিকা হিসেবে উপযুক্ত হলেন তার মা
(ধারা-৩৫৬)।
দ্বিতীয়ত নাবালক বা নাবালিকার সম্পত্তির ক্ষেত্রে নাবালক বা নাবালিকার পিতা
ও দাদা বৈধ ও আইনগত অভিভাবক এবং তাদের অবর্তমানে তাদের নিযুক্তীয়
ব্যক্তিও অভিভাবক নিযুক্ত হতে পারেন (ধারা-৩৫৯)। এ ধরনের অভিভাবক
যৌক্তিক কারণে নাবালক বা নাবালিকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি আদালতের
অনুমতি ছাড়াই হস্তান্তর করতে পারেন (ধারা-৩৬২ ও ৩৬৬)। বৈধ ও আইনগত
অভিভাবকের অবর্তমানে নাবালক বা নাবালিকার মঙ্গলার্থে আদালত নাবালক বা
নাবালিকার পিতৃকুল বা মাতৃকুলের পক্ষ থেকে যে কাউকে সম্পত্তির জন্য
অভিভাবক নিযুক্ত করতে পারেন (৩৬০) এবং এ ধরনের অভিভাবক বৈধ কারণে
নাবালক বা নাবালিকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে
আদালতের অনুমতি ছাড়া করতে পারবেন না (ধারা-৩৬৩)। অন্যদিকে অস্থাবর
সম্পত্তির ক্ষেত্রে একজন অভিভাবক তার নিজের সম্পত্তি যেভাবে দেখাশোনা
করেন, ঠিক অনুরূপভাবে নাবালক বা নাবালিকার সম্পত্তিও দেখাশোনা করবেন
(৩৬৭)। তা ছাড়া আইনগত অভিভাবক না হওয়া সত্ত্বেও কখনও কখনও কেউ
স্বেচ্ছায় নাবালক বা নাবালিকার শরীর ও সম্পত্তির হেফাজতের দায়িত্ব গ্রহণ
করেন, তাকে বাস্তবিক বা কার্যত অভিভাবক বলা হয় (ধারা-৩৬১)। এ ধরনের
অভিভাবকেরও নাবালকের সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষমতা নেই (ধারা-৩৬৪) এবং
অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে এ ধরনের অভিভাবকের ক্ষমতা আইনানুগ
অভিভাবকের ক্ষমতার সমান (ধারা-৩৬৮)।
তৃতীয়ত নাবালক বা নাবালিকার বিয়ে। নাবালক বা নাবালিকার বিয়ের ক্ষেত্রেও পিতা
ও দাদার ওপর বর্তায়। এদের অবর্তমানে মা-সহ মাতৃকুলের জ্ঞাতিদের ওপর
বর্তায় (ধারা-২৭১)। যদিও বর্তমানে প্রচলিত আইনে নাবালক বা নাবালিকার বিয়ে
আইনগতভাবে দণ্ডনীয় অপরাধ।
এদিকে নাবালক বা নাবালিকার শরীর ও সম্পত্তির জন্য যেকোনো ব্যক্তি যৌক্তিক
কারণে অভিভাবক বা অভিভাবিকা নিযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালতে
আবেদন করতে পারেন (ধারা-৩৪৯)। আবেদনকারীর অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব
পালনের দৈহিক ও মানসিক যোগ্যতা, চরিত্র ও স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য এবং নাবালক
বা নাবালিকার সার্বিক মঙ্গলসহ উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করে আদালত
নাবালক বা নাবালিকার শরীর ও সম্পত্তির অভিভাবক নিয়োগের আদেশ প্রদান করে
থাকেন (ধারা-৩৫০-৩৫১)।
পরিশেষ বলা যায়, কোনো নাবালক বা নাবালিকাকে যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে গড়ে
তোলার জন্যই অভিভাবক-অভিভাবিকার ভূমিকা অপরিসীম। একজন অভিভাবক বা
অভিভাবিকার দায়িত্ব হলো নাবালক বা নাবালিকার শরীর ও সম্পত্তি সঠিকভাবে
দেখাশোনার মাধ্যমে তাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে প্রকৃত মানুষ হিসেবে
গড়ে তোলা।