সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ কখনও একা বসবাস করতে পারে না। তাই
প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। এ কারণেই নর-নারী
আইনগতভাবে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দাম্পত্য জীবন পালনসহ একত্রে সংসার
জীবন শুরু করেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সংসার জীবনে নানা রকম মনোমালিন্যসহ
ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়, তা নিরসনের লক্ষ্যে ‘পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ
১৯৮৫’ প্রণীত হয়।
পরবর্তীতে ‘পারিবারিক আদালত আইন, ২০২১’ প্রণয়ন করা হলেও তা এখনও
কার্যকর হয়নি। উল্লেখ্য, সমাজে মানুষের বাহ্যিক আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্য
রাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন ধরনের আইন প্রণয়ন করে থাকে। যেমন- সামাজিক আইন,
প্রাকৃতিক আইন, ফৌজদারি আইন, প্রশাসনিক আইন ও জরুরি আইন ইত্যাদি।
‘পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫’ একটি সামাজিক আইন বটে। ওই
অধ্যাদেশের ১(২) ধারা অনুযায়ী পার্বত্য রাঙামাটি, পার্বত্য বান্দরবান ও পার্বত্য
খাগড়াছড়ি জেলাসমূহ ব্যতীত সমগ্র বাংলাদেশে এ আইন প্রযোজ্য এবং ৪ ধারা
অনুযায়ী বাংলাদেশে অবস্থিত সব সহকারী জজ/ সিনিয়র সহকারী জজ আদালত
পারিবারিক আদালত হিসেবে বিবেচিত হয় এবং সব সহকারী জজ/ সিনিয়র সহকারী
জজ পারিবারিক আদালতের বিচারক হিসেবে বিবেচিত হয়। ওই অধ্যাদেশের ৫ ধারা
অনুযায়ী ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ-এর বিধানাবলি সাপেক্ষে
১. বিয়ে বিচ্ছেদ, ২. দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার, ৩. দেনমোহর, ৪. ভরণপোষণ, ৫.
সন্তানদের অভিভাবকত্ব ও তত্ত্বাবধান নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে
পারিবারিক আদালতের এখতিয়ার রয়েছে। যেমন-
বিয়ে বিচ্ছেদ : বিয়ে বিচ্ছেদের বিষয়ে মুসলিম আইনের ৩০৭-৩৩৬ ধারায় এবং
১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশের ৭ ও ৮ ধারায় বর্ণিত রয়েছে। একজন
মুসলিম পুরুষ তার স্ত্রীকে যেকোনো অবস্থায় তালাক দিতে পারেন। কিন্তু
কাবিননামার ১৮নং কলামে স্ত্রীকে তালাকের ক্ষমতা অর্পণ করা না হলে
সেক্ষেত্রে স্ত্রী বিয়ে বিচ্ছেদের ডিগ্রির জন্য পারিবারিক আদালতে মামলা করতে
পারেন।
দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার : এ বিষয়ে মুসলিম আইনে ২৮১ ধারায় বর্ণিত রয়েছে।
স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্য জীবন ব্যাহত হলে এবং সংসার জীবনযাপনে কোনো
কারণে বিঘ্ন ঘটলে স্বামী-স্ত্রী যে কেউ পারিবারিক আদালতের আশ্রয় গ্রহণ
করতে পারেন।
দেনমোহর : এ বিষয়ে মুসলিম আইনের ২৮৫-৩০৬ ধারায় এবং ১৯৬১ সালের
পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ১০ ধারায় বর্ণিত রয়েছে। একজন স্ত্রীকে তার
প্রাপ্য তাৎক্ষণিক মোহরানা যে তারিখে স্বামী দিতে অগ্রাহ্য করেছে সে তারিখ
থেকে তিন বছরের মধ্যে এবং বিলম্ব মোহরানার ক্ষেত্রে বিচ্ছেদের তারিখ থেকে
তিন বছরের মধ্যে একজন স্ত্রী তার মোহরানার দাবিতে স্বামীর বিরুদ্ধে
পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারেন।
ভরণপোষণ : এ বিষয়ে মুসলিম আইনের ২৭৭-২৮০ ধারায় এবং ১৯৬১ সালের মুসলিম
পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৯ ধারায় বর্ণিত রয়েছে। স্বামী তার স্ত্রীকে যেদিন
থেকে বৈধ কারণ ব্যতীত খোরপোষ দিতে অস্বীকার করেন, সেদিন থেকে স্ত্রী তিন
বছরের মধ্যে পারিবারিক আদালতে খোরপোষের দাবিতে পারিবারিক আদালতে মামলা
করতে পারেন।
অভিভাবকত্ব : এ বিষয়ে মুসলিম আইনের ৩৪৮-৩৬৮ ধারায় বর্ণিত রয়েছে। কোনো
নাবালক সন্তানের শরীর ও সম্পত্তির অভিভাবকত্ব ও হেফাজত নিয়ে কোনো
বিরোধ সৃষ্টি হলে স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ পারিবারিক আদালতে মামলা করতে
পারেন। ওই আইনের ৬ ধারা অনুযায়ী যে আদালতের এখতিয়ারাধীন স্থানীয় সীমানার
মধ্যে নালিশের কারণ সম্পূর্ণরূপে বা আংশিকভাবে উদ্ভব হয়েছে বা পক্ষসমূহ
একসঙ্গে বসবাস করেন বা সর্বশেষ বসবাস করেছেন সে আদালতে পারিবারিক
মামলা করতে হয়। তবে শর্ত থাকে যে বিবাহ ভঙ্গ, দেনমোহর, খোরপোষের জন্য সে
আদালতের এখতিয়ার থাকবে, যে আদালতের স্থানীয় সীমার মধ্যে স্ত্রী বসবাস
করেন। ওই আইনের ১০ ও ১৩(১) ধারা অনুযায়ী বিচারপূর্ব এবং বিচারপরবর্তী
রায়ের পূর্বে আপস-মীমাংসার সুযোগ রয়েছে। ওই আইনের ১৬(ক) ধারা অনুযায়ী
পারিবারিক আদালত কর্তৃক অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ প্রদানের ক্ষমতা রয়েছে
এবং ১৭ ধারা অনুযায়ী পারিবারিক আদালতের রায়, ডিগ্রি বা আদেশের বিরুদ্ধে জেলা
জজ আদালতে আপিল করা যাবে। তবে বিয়ে বিচ্ছেদ এবং ৫ হাজার টাকার ঊর্ধ্বে
নয় এমন মোহরানার ডিগ্রির বিরুদ্ধে আপিল করা যায় না। অন্যান্য ক্ষেত্রে রায়,
ডিক্রি বা আদেশ ঘোষণার তারিখ হতে অনুলিপি সংগ্রহের সময় ব্যতীত ৩০ দিনের
মধ্যে আপিল করতে হয়।
এবার দেখা যাক পারিবারিক আদালত কি শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য প্রযোজ্য?
এর উত্তরে বলা যায় এ বিষয়ে ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশে স্পষ্ট
কিছু বলা না থাকলেও নির্মল কান্তি দাস বনাম শ্রীমতি বিভা রানী [১৪ বি এলডি
(হাইকোর্ট) ৪১৩], মেহের নিগার বনাম মো. মজিবুর রহমান [১৪ বিএলডি
(হাইকোর্ট) ৪৬৭], পচন রিকসি দাস বনাম খুকু রানী দাসী [৫০ ডিএলআর
(হাইকোর্ট) ৪৭] মামলায় উচ্চ আদালত অভিমত প্রদান করেন যে ১৯৮৫ সালের
পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশের আওতায় শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে কোনো
নাগরিকের অধিকারকে খর্ব করবে না। যেমন- একজন মুসলিম নারী তার সন্তানের
তত্ত্বাবধায়ক বা ভরণপোষণ নিয়ে যেমন পারিবারিক আদালতে মামলা করতে পারেন
তেমনি একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারীও মামলা করতে পারবেন।
পরিশেষে বলা যায়, পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য পারিবারিক বিশেষ আদালত
গঠন করা হলেও সব ধরনের পারিবারিক বিরোধ বা অপরাধ পারিবারিক আদালতের
অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, ফলে একই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একটি ঘটনাকে
কেন্দ্র করে সৃষ্ট পারিবারিক অপরাধের ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীকে ভিন্ন ভিন্ন
আদালতে পৃথক পৃথক মামলা করতে হয়। যেমন- পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও
সুরক্ষা) আইন, ২০১০-এর অধীনে পারিবারিক সহিংসতা অপরাধ, যৌতুকনিরোধ
আইন ২০১৮-এর অধীন যৌতুক দাবির অপরাধ, পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন,
২০১৩-এর অধীন পিতা-মাতার ভরণপোষণে অস্বীকৃতির অপরাধ, নারী ও শিশু
নির্যাতন দমন আইন ২০০০-এর অধীন যৌতুকের দাবিতে অপরাধ ইত্যাদি। এসব
অপরাধ পারিবারিক অপরাধ হলেও এসব অপরাধের বিচার করার এখতিয়ার
পারিবারিক আদালতের নেই। সুতরাং আইন সংশোধন করে উল্লিখিত আইনসমূহে
সংঘটিত অপরাধের বিচারও পারিবারিক আদালতের এখতিয়ারাধীন করা একান্ত
আবশ্যক।
এ ছাড়াও প্রতিটি সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজ দেওয়ানি বিচারিক
আদালতের বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট জেলা বা উপজেলায়
পারিবারিক আদালতের দায়িত্ব পালন করেন। আদালতের বিচারকার্য পরিচালনার
জন্য কোনো নির্দিষ্ট বিচারক না থাকায় পারিবারিক আদালত আশানুরূপভাবে
পারিবারিক বিরোধ নিষ্পত্তি করতে সক্ষম হচ্ছেন না। তাই পারিবারিক সমস্যার
সমাধানকল্পে পারিবারিক আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি করা একান্ত আবশ্যক।