সম্প্রতি বিভিন্ন জরীপে প্রকাশিত, বাংলাদেশে বিশেষত শহরাঞ্চলে স্বামী-স্ত্রীর
মধ্যকার মনোমালিন্য ও বিবাহ-বিচ্ছেদ আশংকাজনকহারে ক্রমবর্ধমান।
পারস্পরিক ভালোবাসা, আস্থা-বিশ্বাস ও শ্রদ্ধাবোধের অভাব, নৈতিক ও সামাজিক
অবক্ষয় এজন্য দায়ী। পিতা মাতার খারাপ সম্পর্ক ও বিচ্ছেদ সন্তানদের উপর
মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং তাদের সুষম বিকাশ ব্যাহত করে। তাছাড়া
সন্তানের জিম্মা নিয়ে নতুন দ্বন্দ্ব ও বৈরিতার সূত্রপাত হয় যা শেষ পর্যন্ত
আদালতের বারান্দায় গড়ায়। এমনকি আদালতের বারান্দায় পক্ষদ্বয়ের মাঝে
বলপ্রয়োগের দৃষ্টান্তও চোখে পড়ে। অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের জিম্মা ও
অভিভাবকত্ব কে পাবেন, এ সংক্রান্তে আইনি বিধান ও উচ্চ আদালতের নজিরসমূহ
নিম্নে তুলে ধরা হলঃ
সন্তানের জিম্মা ও অভিভাবকত্ব সম্পর্কিত আইনঃ
আমাদের দেশে সন্তানের জিম্মা ও অভিভাবকত্ব নিয়ে বিরোধ সংক্রান্তে মৌলিক
(Substantive) ও পদ্ধতিগত (Procedural) আইনসমূহ হল- মুসলিম আইন
(Traditional Muslim Law, অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন (The Guardians and
Wards Act), ১৮৯০ এবং পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ (The Family Courts
Ordinance), ১৯৮৫। সন্তানের জিম্মা ও অভিভাবকত্বের মামলা যদিও পারিবারিক
আদালত (সহকারী জজ) কর্তৃক বিচার্য, বিচারপ্রার্থীরা কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি
সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের
অনুচ্ছেদ ১০২(২)(খ)(অ) অনুযায়ী রিট মামলা (Writ of Habeas Corpus) দায়ের
করেও প্রতিকার লাভ করেন।
জিম্মা ও অভিভাবকত্ব নিয়ে সাধারণ মুসলিম আইনের বিধানসমূহ ডি,এফ, মোল্ল্যা
সংকলিত “Principles of Mahomedan Law” বইয়ের ১৮শ অধ্যায়ে (ধারাঃ ৩৪৮-
৩৬৮) বিধৃত হয়েছে। উল্লেখ্য যে, মুসলিম আইনের বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ তথা
হেদায়া, ফতোয়া-ই-আলমগিরি, সিরাজী প্রভৃতির আলোকে ডি,এফ, মোল্ল্যা উক্ত
বইটি সংকলন করেন। সন্তানের জিম্মা সংক্রান্তে উক্ত বইয়ের কতিপয়
উল্লেখযোগ্য বিধান নিম্নরূপ।
উক্ত ধারাসমূহের আলোকে সাধারণ মুসলিম আইনের প্রতিষ্ঠিত বিধান হল, ছেলে
সন্তানের ক্ষেত্রে সাত বছর বয়স পর্যন্ত জিম্মার অধিকার মায়ের, সাত বছর পূর্ণ
হলে বাবার। আর মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে সাবালকত্ব (Puberty) পর্যন্ত জিম্মার
অধিকার মায়ের, আর সাবালকত্বের পর বাবার। তবে, মাতা তার অধিকার হারাবেন
যদি তিনি অন্য কাউকে বিয়ে করেন যিনি সন্তানের সাথে গাইরে মাহরাম (অর্থাৎ
যার সাথে বিয়ে করা নিষিদ্ধ নয়); অথবা যদি মাতা বিবাহ কার্যকর থাকাবস্থায়
পিতার আবাসস্থল ছেড়ে দূরে অন্যত্র চলে যান বা বসবাস করেন; অথবা যদি তিনি
অনৈতিক জীবন যাপন করেন; অথবা যদি তিনি সন্তানের যথাযথ যত্ন নেয়ার
ক্ষেত্রে অবহেলা করেন।
পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এর ধারা ২৪ অনুযায়ী “The Guardians and
Wards Act, 1890” এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে পারিবারিক আদালত (সহকারী জজ)
জেলা আদালত (District Court) হিসেবে বিবেচিত হবে। The Guardians and Wards
Act, 1890, এর ধারা ১৭ অনুযায়ী, সন্তানের জিম্মা ও অভিভাবকত্বের অধিকার
নির্ধারণের ক্ষেত্রে আদালত নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করবেন:
- ১. অপ্রাপ্তবয়স্ক (minor) সন্তানের প্রতি প্রযোজ্য আইনের বিধান (মুসলিম হলে
মুসলিম আইন, হিন্দু হলে হিন্দু আইন, খ্রিস্টান হলে খ্রিস্টান আইন)।
- ২. সংশ্লিষ্ট প্রেক্ষাপটে যা উক্ত সন্তানের জন্য কল্যাণকর হবে। কল্যাণ
(Welfare) নির্ধারণের জন্য আদালত উক্ত সন্তানের বয়স, লিঙ্গ, ধর্ম, প্রস্তাবিত
অভিভাবকের চরিত্র, সক্ষমতা, আত্মীয়তার সম্পর্কের নৈকট্য ও মৃত পিতা বা
মাতার ইচ্ছা এবং উক্ত সন্তানের জিম্মা ও সম্পত্তি সংক্রান্তে বিদ্যমান ও
পূর্বেকার সম্পর্ক।
- ৩. উক্ত অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের বুদ্ধিদীপ্ত অগ্রাধিকারমূলক মতামত।
অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের কল্যাণ নিশ্চিত করতে গিয়ে তার জিম্মার অধিকারী
নির্ধারণে সাধারণ মুসলিম আইনের বিধান থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে কিনা, এ প্রশ্নে
পক্ষে বিপক্ষে আলোচনা থাকলেও ১৯৬৫ সালে মোসাঃ জোহরা বেগম বনাম শেখ
লতিফ আহমদ মুনাওয়ার, ১৭ ডিএলআর ১৩৪, মামলায় পশ্চিম পাকিস্তান হাইকোর্ট
বিচ্যুতির পক্ষে অবস্থান নেন এবং সাত বছর বয়স পূর্ণ হওয়া সত্বেও খালিদ
লতিফ নামক পুত্র সন্তানের জিম্মা তার পিতা শেখ লতিফ আহমদ মুনাওয়ারের
পরিবর্তে তার মাতা মোসাঃ জোহরা বেগমের অনুকূলে প্রদান করেন। অত্র মামলায়
আদালত বলেন, অত্র মামলার সিদ্ধান্তের আলোকে পরবর্তীতে অনেক মামলায়
অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের কল্যাণ নিশ্চিত করার স্বার্থে সাধারণ মুসলিম আইনের
বিধান থেকে সরে আসা হয়। নিম্নে এরকম উল্লেখযোগ্য মামলাগুলো তুলে ধরা হল।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি বনাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং
অন্যান্য, ২৮ বিএলডি ৫৮০
পুলিশের একজন ডিআইজির স্ত্রী আনোয়ারা রহমানের একসাথে সাত সন্তানের জন্ম
দেয়া নিয়ে পত্র পত্রিকায় খবর ছাপানো হয়। অভিযোগ ছিল যে, ডিআইজির স্ত্রী
বিভিন্ন বয়সের বাচ্চাদের সংগ্রহ করে বিদেশে পাচার করতেন। পূর্বোক্ত সাত
বাচ্চাদের পাচার করা হতে পারে, এ আশংকায় বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী
সমিতি (বিজেএমএএস) সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে গণপ্রজাতন্ত্রী
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২(২)(খ)(অ) অনুযায়ী রিট মামলা (Writ of
Habeas Corpus) দায়ের করেন। উক্ত মামলায় ডিআইজি ও তার স্ত্রী বাংলাদেশে
Parentage DNA Test করাতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে দুই ধরণের
পরীক্ষার (Sibling DNA Test, Y-Chromosome Analzsis) ফলাফলের ভিত্তিতে
আদালত নিশ্চিত হন যে, সাত বাচ্চা একে অপরের ভাই বোন নয়, যা প্রমাণ করে যে,
তারা ডিআইজির স্ত্রীর সন্তান নয়। তখন আদালত কল্যাণ (Welfare) নিশ্চিত
করার জন্য সাত বাচ্চার জিম্মা বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির অনুকূলে
প্রদান করেন। অত্র মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ বলেন,
“While deciding the custody of a child in the writ of habeas corpus, the Court is
not bound to deliver a child into the custody of any claimant or of person. In
exercise of its sound discretion, the Court should give the child in such custody
as the welfare of the child requires.”