জটিল আইনি বিধি-বিধান এবং যথাযথ দলিলপত্র নির্ধারিত
পদ্ধতিতে উপস্থাপনের কারণে বাংলাদেশে কোন কোম্পানি
নিবন্ধিত করাটা কিছুটা কষ্টসাধ্য। কিন্তু এই জটিল প্রক্রিয়াকে
সহজতর করার জন্য সিম্পলবুকসের ৫টি ধাপ অনুসরণ করলে খুব
কম সময়েই বাংলাদেশে কোম্পানি নিবন্ধন করা যায়।
শুরু করার আগে চলুন জেনে নেই কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ঃ
১. পরিচালকবৃন্দ – প্রতিটি কোম্পানির পরিচালকের
সংখ্যা কমপক্ষে দুজন (আবাসিক কিংবা অনাবাসিক) হতে হবে এবং
পরিচালকবৃন্দের পদবী এবং শেয়ারের সংখ্যা স্পষ্টভাবে
কোম্পানির সংঘবিধিসমুহে (Articles of Association) উল্লেখ
থাকতে হবে। এর সাথে লক্ষ্য রাখতে হবে ১৮ বছরের কম কিংবা
দেউলিয়া কিংবা কোনোরূপ আর্থিক অপরাধমূলক কার্যকলাপে
লিপ্ত থাকা প্রমাণিত হলে পরিচালকগণ অযোগ্য বলে বিবেচিত
হবেন।
২. অংশীদারগণ – একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির অংশীদারের
সংখ্যা হতে পারে সর্বনিম্ন ২ জন হতে সর্বোচ্চ ৫০ জন। পাবলিক
লিমিটেড কোম্পানির জন্য এ সংখ্যা হবে সর্বনিম্ন ৭ জন এবং এর
বেশী। কোন কোম্পানির অংশীদার কোন ব্যাক্তি ও হতে পারেন
কিংবা অন্য কোন একটি কোম্পানিও হতে পারে এবং কোম্পানির
পরিচালকগণও কোম্পানির অংশীদার হতে পারেন।
৩. অনুমোদিত মূলধন (Authorized Capital) –
কোন নিবন্ধিত
কোম্পানির অনুমোদিত মূলধন হল ঐ কোম্পানিটির সর্বোচ্চ
পরিমাণ মূলধনের সীমা যা প্রতিটি অংশীদারদের মধ্যে বণ্টন করা
হয়। এই পরিমাণের সংখ্যা স্পষ্টভাবে সংঘ স্মারক
(Memorandum of Association) এবং সংঘবিধিসমুহে (Articles
of Association) অবশ্যই উল্লেখ থাকতে হবে এবং এসকল
দলিলপত্র নিবন্ধনের পূর্বেই যথাযথভাবে প্রস্তুত করে নিতে হবে।
৪. নিবন্ধনের ঠিকানা –
কোম্পানি নিবন্ধনের জন্য অবশ্যই একটি
প্রাসঙ্গিক ঠিকানা (আবাসিক কিংবা বাণিজ্যিক) প্রদান করতে
হবে যা কোম্পানির নিবন্ধিত ঠিকানা বলে বিবেচিত হবে।
৫. পরিশোধিত মূলধন (Paid-Up Capital) –
নিবন্ধনের সময় কোন
কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন বা মূলধন সর্বনিম্ন ১ টাকা হতে
হবে। নিবন্ধনের পর অনুমোদিত সীমার মধ্যে যে কোন পরিমাণ
অর্থ কোম্পানির মূলধন হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
চলুন জেনে নেই কি কি ধাপ অনুসরণ করলে বাংলাদেশে কোম্পানি
নিবন্ধন করা যায়।
প্রথম ধাপ: কোম্পানির নামের ছাড়পত্র
কোম্পানির নিবন্ধন প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হল কোম্পানির নামের
জন্য যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (Registrar
of Joint Stock Companies and Firms) হতে একটি ছাড়পত্র
সংগ্রহ করা। এ ছাড়পত্র সংগ্রহের জন্য নিম্নের ধাপগুলো
অনুসরণ করতে হবেঃ
১. যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তর এর
ওয়েবসাইটে প্রবেশ করুন।
২. একটি ইউজার আইডি তৈরি করুন। (উদাঃ companyname123)
৩. Name clearance এ আবেদন করুন।
এই আবেদনের জন্য ওয়েবসাইট থেকে একটি পেমেন্ট স্লিপ প্রদান
করা হবে যেটি দিয়ে আপনি নির্ধারিত ব্যাংকে নামের ছাড়পত্রের
জন্য সরকারী ফি ৳ ২০০/- (দুইশত টাকা) এবং ভ্যাট ৳ ৩০/- (ত্রিশ
টাকা) জমা প্রদান করতে পারবেন। জমা প্রদানের পর আপনার
ইউজার আইডিতে পুনরায় লগ-ইন করুন। জী হ্যাঁ, আপনার
কোম্পানির নামের জন্য যৌথমূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের
পরিদপ্তর হতে অনুমোদন সংগ্রহ করা হয়ে গিয়েছে!
পরবর্তী ধাপগুলোতে যাওয়ার পূর্বে কিছু বিষয় লক্ষ্য করুনঃ
- ১টি আবেদনের জন্য শুধুমাত্র ১টি কোম্পানির নামের জন্য
অনুমোদন প্রদান করা হবে।
- এই অনুমোদনের বা ছাড়পত্রের মেয়াদ থাকবে অনুমোদিত
হওয়ার পরবর্তী ৩০ দিন।
- এই অনুমোদন বা ছাড়পত্রের মেয়াদ ৬০ দিন হতে সর্বোচ্চ
৯০ দিন পর্যন্ত বর্ধিত করা যাবে।
- অনাবাসিক কোম্পানি কিংবা অংশীদারি ফার্মের জন্য এই
ছাড়পত্রের কোন বাধ্যবাধকতা নেই।
দ্বিতীয় ধাপ: দরকারী কাগজপত্র প্রস্তুতকরণ
বাংলাদেশে আপনার কোম্পানি নিবন্ধিত করতে হলে নিম্নে বর্ণিত
কাগজপত্রাদি প্রয়োজন হবে। কি ধরনের কোম্পানী নিবন্ধন
করবেন সেটার উপর নির্ভর করবে কাগজপত্রের চাহিদা।
কোম্পানি আইন ১৯৯৪ অনুযায়ী, প্রাইভেট কোম্পানির ক্ষেত্রে যা
যা প্রয়োজন হবে;
১) মেমোরেন্ডাম অব এসোসিয়েশন ও আর্টিকেল অব এসোসিয়েশন
এর মূলকপি (অতিরিক্ত দুই কপি সহ)
২) ফরম I পূরণঃ কোম্পানি নিবন্ধনের ঘোষণা [অনুচ্ছেদ-২৫]
৩) ফরম VI পূরণ- নিবন্ধিত অফিসের অবস্থান বা তার
পরিবর্তনের নোটিশ [অনুচ্ছেদ-৭৭]
৪) ফরম IX পূরণ- পরিচালকের সম্মতিপত্র [অনুচ্ছেদ-৯২]
৫) ফরম X পূরণ- পরিচালক হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের তালিকা
[অনুচ্ছেদ ৯২]
৬) ফরম XII পূরণ- পরিচালক, ব্যবস্থাপক এবং ব্যবস্থাপনা
এজেন্টদের তথ্য এবং তাতে কোন পরিবর্তন [অনুচ্ছেদ ১১৫]
৭) নামের ছাড়পত্র
যেখানে পাবলিক কোম্পানীর ক্ষেত্রে প্রয়োজন পড়বে;
১) মেমোরেন্ডাম অব এসোসিয়েশন ও আর্টিকেল অব এসোসিয়েশন
এর মূলকপি (অতিরিক্ত দুই কপি সহ)
২) ফরম I পূরণঃ কোম্পানি নিবন্ধনের ঘোষণা [অনুচ্ছেদ-২৫]
৩) ফরম VI পূরণ- নিবন্ধিত অফিসের অবস্থান বা তার
পরিবর্তনের নোটিশ [অনুচ্ছেদ-৭৭]
৪) ফরম IX পূরণ- পরিচালকের সম্মতিপত্র [অনুচ্ছেদ-৯২]
৫) ফরম X পূরণ- পরিচালক হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের তালিকা
[অনুচ্ছেদ ৯২]
৬) ফরম XII পূরণ- পরিচালক, ব্যবস্থাপক এবং ব্যবস্থাপনা
এজেন্টদের তথ্য এবং তাতে কোন পরিবর্তন [অনুচ্ছেদ ১১৫]
৭) ফরম XIV পূরণ-বিবরণীর পরিবর্তে কোম্পানি ফাইলিং
স্ট্যাট্মেন্ট এর ক্ষেত্রে ব্যবসা শুরুর পূর্বে
ঘোষণাপত্র [অনুচ্ছেদ ১৫০]
৮) ফরম XI পূরণ (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)- প্রস্তাবিত কোম্পানির
যোগ্যতা শেয়ার গ্রহণের চুক্তিপত্র [অনুচ্ছেদ ৯২]
৯) নামের ছাড়পত্র
অন্যদিকে বিদেশি কোম্পানীর ক্ষেত্রে প্রয়োজন পড়বে;
১) ফরম XXXVI পূরণ- সনদ বা সংঘবিধি বা মেমোরেন্ডাম এবং
কোম্পানির আর্টিকেল অথবা কোম্পানির সংবিধান গঠনকারী বা
সংজ্ঞায়নকারী কোনো দলিল,
২) ফরম XXXVII পূরণ- কোম্পানির নিবন্ধিত বা প্রধান অফিসের
ঠিকানা,
৩) ফরম XXXVIII পূরণ – পরিচালক এবং ব্যবস্থাপকদের
(ম্যানাজার) এর তালিকা [অনুচ্ছেদ ৩৭৯],
৪) ফরম XXXIV পূরণ- সেবা গ্রহণ করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত
ব্যক্তির রিটার্ন,
৫) ফরম XLII পূরণ- বাংলাদেশে কার্যক্রমের প্রধান স্থানের
অবস্থান বা তাতে কোন পরিবর্তন,
৬) কোন তফসিলি ব্যাংক থেকে মুদ্রা নগদীকরণ (ইনক্যাশমেন্ট)
সার্টিফিকেট,
৭) বাংলাদেশের বিনিয়োগ বোর্ডের কাছ থেকে অনুমতিপত্র।
তৃতীয় ধাপ: নতুন ব্যাংক একাউন্ট খোলা
এই ধাপটা খুবই সোজা। আপনাকে এই ধাপে এসে যেটা করতে হবে
সেটা হচ্ছে আপনার প্রস্তাবিত কোম্পানীর নামে বাংলাদেশে
তালিকাভূক্ত যেকোনো একটি ব্যাংকের অধীনে একটি ব্যাংক
একাউন্ট খুলতে হবে। শেয়ারহোল্ডার হিসেবে যদি কোনো বিদেশি
থেকে থাকেন তবে তার অধীনে থাকা শেয়ারের সমপরিমাণ টাকা
ব্যাংকে জমা করতে হবে।
কারণ? এর ফলে ব্যাংক একটি মুদ্রা নগদীকরণ সার্টিফিকেট
প্রদান করবে যা রেজিস্ট্রেশনের সময় আরজেএসসি কর্তৃক
প্রয়োজন পরবে।
চতুর্থ ধাপ: সফলভাবে কাগজপত্র জমাদান
এখানেই শেষ না, তবে আপনি পথের প্রায় শেষ দিকে আছেন!
নিবন্ধন প্রক্রিয়ার এই চতুর্থ এবং শেষ পর্যায়ে আরজেএসসি’র
ওয়েবসাইটে গিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রাদি দাখিল করতে হবে।
কোম্পানীর নামের ছাড়পত্র পাওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য
প্রয়োজনীয় নথি পেতে যা দরকারঃ
(ক) মেমোরান্ডাম এবং আর্টিকল অফ এসোসিয়েশন সহ অন্যান্য
কাগজপত্রাদি আর আরজেএসসি’র ওয়েবসাইটে বর্ণিত নির্ধারিত
ফরম্যাট মেনে প্রস্তুত করা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করুন।
(খ) নামের ছাড়পত্র পাওয়ার পর পরবর্তি ৩০ দিনের মধ্যে
অনলাইনে (আরজেএসসি ওয়েবসাইটে) নিবন্ধনের
জন্য আবেদন করুন।
(গ) ব্যাংকে নির্ধারিত নিবন্ধন ফী পরিশোধ করুন (ওয়েবসাইট হতে
এ ক্ষেত্রে একটি জমা রশিদ প্রদান করা হবে)
নিবন্ধনের জন্য যেভাবে আবেদন করবেন:
- এই লিঙ্কে প্রবেশ করুন
- Select the “Type” of Company you will be registering
- যে কোম্পানীর নিবন্ধন করা হবে তার ‘Type” নির্বাচন করুন
- নামের ছাড়পত্র জমা নম্বর (Name Clearance
Submission No.) এবং নামের ছাড়পত্র চিঠির নম্বর
(Name Clearance Letter No.) নির্ধারিত জায়গায় লিখুন
- “Continue” অংশে ক্লিক করুন
- এরপর যে ফর্ম টি আসবে তা পূরণ করুন
- নির্ধারিত ফরম্যাটে মেমোরান্ডাম এবং আর্টিকল অফ
এসোসিয়েশন সংক্রান্ত প্রয়োজনমাফিক তথ্য প্রদান করুন
- Confirm all the details submitted
- প্রদানকৃত সকল তথ্য নিশ্চিত (Confirm) করুন
- “Submit” অংশে ক্লিক করুন
ওয়েবসাইট হতে জমা রশিদ পাওয়ার পর আপনার কাজ হচ্ছে সেই
অনুযায়ী ফী ব্যাংকে পরিশোধ করা। পরিশোধ সম্পন্ন হয়েছে?
অভিনন্দন – আপনার কোম্পানি এখন আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত
হয়েছে!
এটা এখানেই শেষ না যদিও, পরবর্তিতে আপনাকে নিয়মিত
আরজেএসসিতে খোঁজ খবর রাখতে হবে যেহেতু নিবন্ধন প্রক্রিয়ায়
সন্তুষ্ট হলে তারাই আপনাকে নিম্নে বর্ণিত নথির ডিজিটালি
স্বাক্ষরিত অনুলিপি প্রদান করবে,
- সার্টিফিকেট অফ ইনকর্পোরেশন
- মেমোরান্ডাম এবং আর্টিকল অফ এসোসিয়েশন
- ফর্ম XII (১২), যে ইমেইল প্রদান করা হয়েছে সে মাধ্যমে
যদি কোনোভাবে নিবন্ধন প্রক্রিয়া এক্টু ধীরগতির হয় – তবে
চিন্তা করবেন না! এ ক্ষেত্রে আরজেএসসির কর্মকর্তারা
অতিরিক্ত আরো কিছুর তথ্য চাইতে পারেন যা আপনার গিয়ে প্রদান
করে আসতে হবে।
আরজেএসসির ওয়েবসাইট সংক্রান্ত আরো পূর্ণাঙ্গ নির্দেশিকা
পেতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন!
পঞ্চম ধাপ: নিবন্ধন পরবর্তি প্রক্রিয়া
এই ধাপটি নিবন্ধন প্রক্রিয়ার কোনো অবিচ্ছেদ্য অংশ নয় তবে
এর মধ্যে সেসব অন্তর্ভূক্ত আছে কোম্পানী নিবন্ধন শেষ হবার
পর সেসব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা প্রয়োজন হতে পারে।
লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে (প্রাইভেট এবং পাবলিক) যা যা নিতে
হবে,
- আবেদনের সাথে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিলের মাধ্যমে
সংশ্লিষ্ট সিটি কর্পোরেশন হতে ট্রেড লাইসেন্স
- জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর ওয়েবসাইটে আবেদনের মাধ্যমে
প্রাপ্ত কর শণাক্তকরণ নম্বর (TIN)
- ওনলাইন আবেদন প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত মূসক নিবন্ধন
সার্টিফিকেট
- বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্স অথরিটি হতে
প্রাপ্ত ফায়ার সার্টিফিকেট
- পরিবেশ অধিদপ্তর হতে প্রাপ্ত পরিবেশ ছাড়পত্রের
সার্টিফিকেট (যদি কোনো শিল্প প্রকল্প জড়িত থাকে)